আপনার স্ত্রীকে ভালবাসুন: ইমানের এক অনন্য শিক্ষা

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত্তি হলো ভালোবাসা, সম্মান, ও একে অপরের জন্য কল্যাণকামী হওয়া। রাসূল (সা.) আমাদের নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে, তাদের সুরক্ষা ও মর্যাদা দিতে অসংখ্যবার বলেছেন। তাঁর শিক্ষাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পারিবারিক সম্পর্ক কেবল একটি সামাজিক বন্ধন নয়; বরং এটি আল্লাহর নির্দেশিত একটি ইবাদত।

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এমন এক সমাজে জন্মেছিলেন যেখানে নারীদের প্রতি ন্যায়বিচার ছিল একপ্রকার অবহেলিত। কিন্তু তাঁর মিষ্টি কথাগুলো ও উদাহরণ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে স্ত্রীর প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা এবং করুণার আচরণ করতে হয়। যেমন, সহিহ বুখারি ও মুসলিমের হাদিসগুলো আমাদের এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। স্ত্রীদের প্রতি প্রেম ও যত্ন প্রদর্শনের মধ্যে এক অভাবনীয় পুরস্কার রয়েছে। কেননা, যে স্বামী তার স্ত্রীর জন্য কল্যাণকামী, সে নিজের জীবনেও প্রশান্তি ও সফলতা লাভ করে।

বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী করিম (সা.) যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা ছিল এক মহৎ শিক্ষা। তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের স্ত্রীর অধিকার রয়েছে যেমন তোমাদেরও রয়েছে। তাদেরকে ভালোভাবে দেখাশোনা করো।” এ কথাগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অমূল্য শিক্ষার এক উপলব্ধি। সংসারের দায়িত্ব পালনের মাঝেও একজন স্বামীর অন্যতম দায়িত্ব হলো তার স্ত্রীকে ভালোবাসা ও তার প্রতি ন্যায় আচরণ করা।

কিন্তু কেবল হাদিস পাঠ করা যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রতিটি হাদিসের আলোকে জীবন গঠন করতে হবে। স্ত্রীকে ভালোবাসার মানে শুধু তার জন্য অর্থ, খাদ্য, বা পোশাক-আশাক সরবরাহ করা নয়। বরং তাকে এমনভাবে দেখা যাতে সে মানসিক প্রশান্তি পায়। ছোট ছোট কথায় স্বীকৃতি, ভালোবাসার মিষ্টি ভাষা, এবং মধুর আচরণ এ সম্পর্ককে আরও গভীর করে তোলে। স্ত্রীকে মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে এবং তার সঙ্গে এমন আচরণ করতে হবে যা তার আত্মসম্মানবোধ বজায় রাখে।

ইসলামে নারীর মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। একটি স্ত্রী যেমন সংসারের সৌন্দর্য বাড়ায়, ঠিক তেমনই সংসারের প্রতিটি সুখে দুঃখে সে একজন সতীর্থ হয়ে থাকে। নবীজি (সা.) আমাদের বলেছেন, যে স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি উত্তম আচরণ করে, সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। উদারতা, সহমর্মিতা, এবং তার জন্য দোয়া করা—এগুলোই একজন ভালো স্বামীর পরিচায়ক।

পারিবারিক বন্ধনকে আল্লাহর নির্দেশিত ইবাদত হিসেবে ভাবতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা যখন পারস্পরিক সম্মান ও দ্বীনের আলোকে পরিচালিত হয়, তখন এই সম্পর্ক একটি পবিত্র বন্ধনে পরিণত হয়। শুধু সামাজিক দায়িত্ব পালন নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এই সম্পর্ককে আরও মধুর করতে হবে।

অতএব, ভালোবাসা ও ইমানের আলোকে গড়ে তোলা এই সম্পর্ক একটি জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান আর্শীবাদ। আল্লাহ আমাদের সকলকে এই পবিত্র সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নতির তৌফিক দান করুন।

অন্তরে ভালোবাসার মহাসাগর তৈরি করুন, এটাই ইমানের প্রকৃত সৌন্দর্য

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ  

মানুষের হৃদয় এমন এক অনুভূতির গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম, যেখানে ভালোবাসার মহাসাগর তৈরি হয়। এই ভালোবাসা অন্যকে বুঝতে শেখায়, ক্ষমাশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে। আসুন, আমরা ভাবি, অন্তরে অপরের জন্য ভালোবাসা তৈরি করা কেন গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মানুষ হিসেবে বারবার কষ্ট পাই, ক্ষোভ জমাই, তবে কেবলই কি ঘৃণা জমিয়ে রাখাই আমাদের ভবিতব্য?

আসলে, মুমিনের হৃদয়ে ঘৃণার স্থান নেই। নবী করিম (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন, ক্ষমা করার এবং মানুষের পক্ষে সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মহান শিক্ষা। তিনি সেই মহৎ আদর্শ রেখে গেছেন, যেখানে একজন মুমিন তার ভাইয়ের জন্য আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেমন উৎকণ্ঠিত থাকে, তেমনই জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য তার জন্য দোয়া করে। এভাবেই মুসলমানিত্বের মানে শুধু ইবাদতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্তরের পবিত্রতা ও হৃদয়ের উদারতায় প্রসারিত।

ভালোবাসার এই মহাসাগর তৈরি করতে হলে প্রথমে নিজেকে জানতে হবে। আমাদের আত্মার গভীরে কি লুকিয়ে আছে? আমরা কি অহংকারে ভুগছি? আত্মগৌরব কি আমাদের নেক আমলগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে? ইসলামের শিক্ষা হল নিজেকে সর্বপ্রথম সংশোধন করা। আত্মার পবিত্রতা অর্জন করাই হচ্ছে আসল সাধনা। যদি আমরা আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালোবাসতে পারি, তাহলে সেই ভালোবাসা আমাদের ইবাদতের মধ্যে প্রতিফলিত হবে। প্রতিটি মানুষকে আমরা জান্নাতের পথে এগিয়ে দিতে চাইবো। জান্নাতের প্রতি আমাদের তৃষ্ণা যেমন দৃঢ়, তেমনই অন্যকে জান্নাতের পথ দেখানোর আন্তরিক চেষ্টা থাকবে।

অহংকার ও ঘৃণার শেকড় যত গভীরেই হোক, আল্লাহর দিকে ফিরে তাকালে সেই শেকড় উপড়ে ফেলা যায়। একজন মানুষ যখন তার অন্তরের আলো দিয়ে অন্যকে আলোকিত করার চেষ্টা করে, তখন সে নিজেও প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। স্রষ্টার ভালোবাসা যার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে, সে জানে মানুষকে ক্ষমা করাই আল্লাহর প্রিয় একটি গুণ। এজন্য আল্লাহ আমাদের অন্তরকে সংবেদনশীল করেছেন।

এখন আমরা দেখি, ভালোবাসা ও ক্ষমার মহিমা কীভাবে আমাদের জীবনকে বদলে দিতে পারে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমরা যদি পরস্পরকে ভালো না বাসো, তবে জান্নাতে যেতে পারবে না।” চিন্তা করুন, এই ছোট্ট বাক্যের কত গভীরতা রয়েছে। আমাদের জীবন তখনই সুন্দর হয়, যখন আমরা ঘৃণার বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসার অমৃত গ্রহণ করি। জাহান্নামের আগুন থেকে যেমন আমরা বাঁচতে চাই, তেমনই আমাদের দায়িত্ব, অন্যকেও সেই আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা।

তাহলে কীভাবে আমরা এই ভালোবাসার মহাসাগর তৈরি করতে পারি? প্রথমেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে, তিনি যেন আমাদের অন্তর পবিত্র করেন। এরপর আমাদের দায়িত্ব হল, মানুষকে জান্নাতের পথে আহ্বান করা, তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করা। আমরা যখন ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করি, তখন তা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে।

এই ভালোবাসার সাথে যুক্ত আছে আরেকটি গুণ, তা হলো বিনয়। একজন প্রকৃত মুমিন বিনয়ের সাথে মানুষের সেবা করে। সে জানে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই তার একমাত্র লক্ষ্য। তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়। জীবনের ক্ষুদ্র আনন্দ বা বড় কষ্ট—সবকিছুতেই সে আল্লাহর স্মরণে প্রশান্তি লাভ করে।

অন্যদিকে, যারা নিজেদের অহংকারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখে, তারা কখনো প্রকৃত সুখ পায় না। আল্লাহর কাছে তারা হয়তো নামাজে দাঁড়ায়, কিন্তু অন্তর কলুষিত থাকে। তাদের ইবাদত থেকে বরকত চলে যায়। কারণ, একজন প্রকৃত মুমিনের জন্য ইবাদত মানে হলো বিনয় এবং ভালোবাসা। সে শুধু নিজের জন্য জান্নাত চায় না, বরং আশপাশের সবাইকে জান্নাতের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।

ভালোবাসা ও দোয়ার মধ্য দিয়ে আমরা এমন এক জীবন গড়তে পারি, যেখানে সবাই আল্লাহর দয়ায় আশ্রিত হয়। আল্লাহর রহমত এত বিশাল যে, তার জান্নাতের দরজা সব মুমিনের জন্য উন্মুক্ত। তাই আসুন, আমরা মানুষের জন্য অন্তরের ভালোবাসার মহাসাগর তৈরি করি। আমাদের এই পথচলা শুধু ইহকালেই নয়, পরকালেও আমাদের শান্তি এনে দেবে।

 

ব্যবসায়িক পার্টনার নির্বাচন: ইসলাম কী বলে?

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ  

ব্যবসায়িক অংশীদার নির্বাচন করা অনেক বড় একটি সিদ্ধান্ত। ইসলাম এই বিষয়ে আমাদের অনেক দিকনির্দেশনা দিয়েছে। একজন ভালো পার্টনার কেবল অর্থনৈতিক স্বার্থই দেখবে না; বরং নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, এবং দায়িত্বশীলতার দিকও বিবেচনা করবে।

পবিত্র কোরআন আমাদের বলে, “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎ মানুষের সঙ্গী হও” (সূরা তাওবা: ১১৯)। এখানে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন আমরা আমাদের সঙ্গী, বন্ধু বা ব্যবসায়িক পার্টনারদের নির্বাচন করার সময় সতর্ক থাকি। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এই সতর্কতা আরও বেশি জরুরি। কারণ অর্থ, ক্ষমতা ও প্রলোভনের মধ্যে একজন বিশ্বস্ত অংশীদার থাকলে সঠিক পথে থাকা সহজ হয়।

রাসূল (সা.) এর উপদেশ

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে থাকবে” (তিরমিজি)। অর্থাৎ একজন বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী শুধুমাত্র এই দুনিয়াতে নয়, আখিরাতে নবীদের সঙ্গেও থাকবে। তাই একজন সৎ পার্টনার নির্বাচন করলে আমাদের উপকার আখিরাতেও পাওয়া যাবে।

বর্তমান বাস্তবতা এবং সমাজবিজ্ঞান

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের সঙ্গীরা আমাদের নৈতিকতা ও সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। ব্যবসার ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। যদি আপনার পার্টনার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক হয়, তাহলে অর্থনৈতিক চাপে কিংবা প্রতিযোগিতায় ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ভালো অংশীদার এমনই হয়, যে শুধু নিজেই লাভবান হবে না; বরং পুরো ব্যবসার এবং উম্মাহর কল্যাণ চিন্তা করবে।

উদাহরণ: আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)

আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন ধনী সাহাবি, যিনি তার নৈতিকতা এবং সততার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার ব্যবসায়িক জীবন ছিল আমাদের জন্য এক অসাধারণ উদাহরণ। তিনি শুধু নিজের লাভের চিন্তা করেননি; বরং উম্মাহর সেবা করেছেন এবং সমাজের কল্যাণে অবদান রেখেছেন।

কীভাবে সঠিক পার্টনার নির্বাচন করবেন?

১. অতীতের খোঁজখবর নিন: সম্ভাব্য পার্টনারের অতীতের রেকর্ড দেখুন। ২. মূল্যবোধের মিল খুঁজুন: আপনি এবং আপনার পার্টনারের উদ্দেশ্য এক হওয়া উচিত। ৩. অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা: পারস্পরিক আর্থিক প্রত্যাশা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখুন। ৪. আল্লাহর পরামর্শ নিন: ইস্তিখারা করুন এবং আল্লাহর কাছে সঠিক পথপ্রাপ্তির দোয়া করুন।

পরিশেষে

ব্যবসায়িক পার্টনার নির্বাচন কেবল আর্থিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমাদের আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক দায়িত্বের অংশ। ইসলাম আমাদের নৈতিক, সৎ এবং আল্লাহভীরু সঙ্গী নির্বাচনের নির্দেশ দিয়েছে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তাহলে আমাদের এই দুনিয়াতেও শান্তি আসবে এবং আখিরাতেও সফলতা অর্জন করব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।

 

 

তুমি বন্ধু কেমন বন্ধু!

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ  

বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি এমন একটি সম্পর্ক, যা আমাদের উত্থান-পতনে গভীর প্রভাব ফেলে। ইসলাম আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান করেছে, এবং বন্ধুত্ব গড়ার ক্ষেত্রেও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) আমাদের গাইড করেছেন। এককথায়, আপনি কাকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিচ্ছেন, তা আপনার দুনিয়া ও আখিরাত উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে।

 পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেছেন, মুমিনদের উচিত সৎ লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। যেমন, তিনি বলেন: হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থেকো।” (সুরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১৯)। এ নির্দেশনার মানে হলো, আমাদের এমন বন্ধু বেছে নেওয়া উচিত যারা আল্লাহকে ভয় করেন এবং সত্যের পথে চলেন। এমন বন্ধুরা আমাদের আল্লাহর পথে থাকতে সাহায্য করবেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মানুষ তার বন্ধুর ধর্মের ওপর চলে। তাই তোমরা দেখো, কার সাথে বন্ধুত্ব করছ।” (আবু দাউদ)। এর অর্থ হলো, আপনি যাদের সঙ্গে মিশছেন, তাদের প্রভাব আপনার ওপর পড়বে। সুতরাং ভালো বন্ধুদের সান্নিধ্য আপনাকে সৎ পথে এগিয়ে নেবে।

 প্রকৃত বন্ধুরা কেবল দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতের জন্যও সহায়। তারা আপনাকে ভালো কাজে উৎসাহিত করবে, পাপ থেকে বিরত রাখবে এবং সবসময় পাশে থাকবে। বর্তমান সমাজে আমরা অনেকেই বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাই, তবে সেই সময় কি আমাদের আত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করছে?

সামাজিক বিজ্ঞানীদের মতে, একজন মানুষের আচরণ ও মানসিকতার ওপর তার বন্ধুরা বড় প্রভাব ফেলে। তাই আপনাকে এমন বন্ধু বেছে নিতে হবে, যারা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 কুরআনে আল্লাহ বলেন, যে দিন জালেম ব্যক্তি তার হাত কামড়ে বলবে, ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সঙ্গে পথ অবলম্বন করতাম! হায়! আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধু না বানাতাম। সে আমাকে বিভ্রান্ত করেছিলো আমার রবের স্মরণ থেকে।” (সুরা ফুরকান, আয়াত ২৭-২৮)।

এখানে আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেন খারাপ বন্ধুদের প্রভাব থেকে। আমরা যদি এমন বন্ধুদের সঙ্গে থাকি, যারা আমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে সরিয়ে দেয়, তাহলে আখিরাতে আমাদের জন্য তা বড় অনুশোচনার কারণ হবে।

 বর্তমানে প্রযুক্তি আমাদের বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। আমরা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে হাজার হাজার ‘ফ্রেন্ড’ পেলেও প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা খুব কম। সোশ্যাল মিডিয়ার এই আসক্তি আমাদের প্রকৃত বন্ধুত্বের জায়গা দখল করে নিয়েছে। তাই আমাদের উচিত বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া।

বন্ধুত্ব এমন হওয়া উচিত, যা আমাদের আত্মিক উন্নতিতে সহায়তা করে এবং আল্লাহর পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে। মহানবী (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন যে, প্রকৃত সফলতা সেই, যিনি দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়েই সুখী। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সৎ এবং আল্লাহভীরু বন্ধু খুঁজে পাওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

আত্মবিশ্বাস ঘন মেঘমালাকেও সরিয়ে দেয়

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ  

আত্মবিশ্বাস এমন এক শক্তি যা জীবনের প্রতিকূলতাগুলোকে পরাস্ত করতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেখানে সাহাবীগণ আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে অতিক্রম করেছেন সীমাহীন চ্যালেঞ্জ। এমনই এক অনুপ্রেরণামূলক ঘটনা আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে আবদের।

আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে আবদ একজন সাহাবী ছিলেন, যিনি ছিলেন অন্ধ। কিন্তু তার এই শারীরিক সীমাবদ্ধতা কখনই তার বিশ্বাসের শক্তিকে কমিয়ে দিতে পারেনি। বরং তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে এতটাই  পারদর্শী ছিলেন যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার তিলাওয়াত শুনে বলেছিলেন, “যে কুরআন তিলাওয়াত করতে চায়, সে যেন আবদুল্লাহ উম্মে আবদের মত তিলাওয়াত করে।”

এক রাতে সাহাবীগণ প্রিয় নবীর (সা.) কাছে বসেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে আবদ তিলাওয়াত শুরু করেন। তার কণ্ঠ এত মাধুর্যময় ছিল যে, প্রতিটি আয়াত হৃদয়কে স্পর্শ করছিল। তার তিলাওয়াতে এমন এক ইখলাস ছিল যা অন্যদেরও আল্লাহর পথে অনুপ্রাণিত করত। তিনি প্রমাণ করলেন যে আত্মবিশ্বাস এবং আল্লাহর উপর ভরসা দিয়ে যে কেউ অসাধ্য সাধন করতে পারে।

ইসলাম আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে শিখিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আমার জন্য চেষ্টা করে, আমি অবশ্যই তাদের পথ দেখাব” (সূরা আনকাবূত: ৬৯)। এই আয়াত আমাদেরকে প্রেরণা জোগায় যে, আমরা যদি চেষ্টা করি এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখি, তাহলে সফলতা অবশ্যম্ভাবী।

প্রতিদিনের জীবনে আমরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হই। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগে উদ্বিগ্ন থাকে, কর্মজীবীরা কাজের চাপে ভেঙে পড়ে। কিন্তু আত্মবিশ্বাস আমাদের সাহায্য করতে পারে। যেকোনো পরিস্থিতিতে স্থির থেকে বিশ্বাস রাখা জরুরি। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে আবদের ঘটনা আমাদের শিখায় যে, শারীরিক বা মানসিক চ্যালেঞ্জ আসবেই, কিন্তু আত্মবিশ্বাস দিয়ে আমরা সবকিছু পার করতে পারি।

আত্মবিশ্বাস আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দরকার। তা হতে পারে স্কুলে ভালো ফল করার জন্য, কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য, বা পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য। আমরা যদি আল্লাহর উপর ভরসা রাখি এবং আমাদের কাজে একনিষ্ঠ থাকি, তবে আমরা নিশ্চয়ই সফল হবো। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে আবদের জীবনের শিক্ষা আমাদেরকে সাহস দেয়, অনুপ্রেরণা দেয় এবং প্রমাণ করে যে কোনো বাধাই আমাদের রুখতে পারে না, যদি আত্মবিশ্বাস শক্তিশালী হয়।

 

যে আমলে আলী (রাঃ) এবং ফাতিমা (রাঃ)’র সংসারে অভাব দূর হয়েছিল

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগ

হযরত আলী (রাঃ) এবং ফাতিমা (রাঃ) এর দাম্পত্য জীবন ছিল এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে তারা দুনিয়ার সম্পদ কিংবা বিলাসিতার পিছনে ছুটে না গিয়ে আত্মবিশ্বাস ও সবর দিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের জীবনে অনেক সময় অভাব-অনটন এসেছে, কিন্তু তারা কখনো ধৈর্য হারাননি। বরং তাদের জন্য প্রকৃত সমৃদ্ধি হলো আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং নিরলস পরিশ্রম ও ইবাদতের মাধ্যমে অভাব-অনটনকে মোকাবেলা করা।

একদিন ফাতিমা (রাঃ) তাঁর পিতা, নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে আর্থিক সাহায্য চান। ফাতিমা (রাঃ)-এর শরীর কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। নবী (সাঃ) তার কন্যার কথা শুনে পরামর্শ দেন একটি বিশেষ আমল করার জন্য, যা অভাব থেকে মুক্তি দিতে পারে এবং তাদের সংসারকে বরকতময় করতে পারে।

নবী (সাঃ) কর্তৃক নির্ধারিত আমল

নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ফাতিমা (রাঃ) এবং আলী (রাঃ)-কে উপদেশ দেন যে, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তারা কিছু বিশেষ জিকির করবেন। আমলটি ছিল খুবই সহজ:

  1. ৩৩ বার সোবহানাল্লাহ – “পবিত্র আল্লাহ” বলে স্মরণ করা। আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসা করা।
  2. ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ – “আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা” বলতে বলা হয়, যা আল্লাহর প্রতিটি নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।
  3. ৩৪ বার আল্লাহু আকবার – “আল্লাহ সর্বশক্তিমান” বলা, যা আল্লাহর মহত্ত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

এ আমলটি ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও ভরসার প্রতীক, এবং তা শুধু আলী ও ফাতিমা (রাঃ) এর জীবনেই নয়, বরং প্রতিটি মুসলিম পরিবারে অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা দুঃখ-কষ্ট ও কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য কার্যকরী হতে পারে।

অভাব দূরীকরণের ব্যাখ্যা

ইসলামের দৃষ্টিতে, অভাবের মূল কারণ শুধুমাত্র সম্পদের অভাব নয়; বরং তা আমাদের অন্তরের অবস্থা এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ঘাটতিও হতে পারে। যখন আমরা আমাদের জীবনে আল্লাহর স্মরণে আত্মনিবেদন করি এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি, তখন আল্লাহ আমাদের জীবনে বরকত দেন। তাই আল্লাহর প্রশংসা করা এবং তাঁকে স্মরণ করা হলো একধরনের ইবাদত, যা দুনিয়ার অভাব থেকে আমাদের রক্ষা করে। আল্লাহর উপর নির্ভরতা আমাদের মনের প্রশান্তি এনে দেয় এবং এই প্রশান্তির কারণেই আল্লাহ আমাদের অভাব দূর করেন।

আলী (রাঃ) ও ফাতিমা (রাঃ)-এর জীবনের শিক্ষা

আলী (রাঃ) এবং ফাতিমা (রাঃ) এর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে, ধৈর্য এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতা আমাদের জীবনে আনে প্রকৃত সুখ। তারা দুনিয়ার সম্পদের পিছনে না ছুটে আল্লাহর স্মরণে এবং তার ইবাদতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এমনকি দুঃসময়ে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা অটুট রেখেছেন।

এই ঘটনার মাধ্যমে আমাদের জীবনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়:

  • কৃতজ্ঞতা: কৃতজ্ঞ হওয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর করুণা লাভ করি, যা আমাদের জীবনের অভাবকে পূর্ণতা দেয়।
  • ধৈর্য: ধৈর্যের মাধ্যমে আমরা জীবনের সংকটগুলোকে মোকাবেলা করতে পারি এবং সফলতার পথে এগিয়ে যেতে পারি।
  • আল্লাহর স্মরণ: আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর সাথে সম্পর্ক তৈরি করার মাধ্যমে আমাদের জীবন হয়ে ওঠে শান্তিময় এবং বরকতময়।

এই আমলের আধুনিক প্রেক্ষাপট

বর্তমান যুগে, মানুষের মনে বিভিন্ন রকমের দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ এবং অভাব-অনটন বিরাজ করে। অনেকেই হয়তো আর্থিক সংকট বা জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েন। নবীজির (সাঃ) এই উপদেশ আমাদের শেখায়, কোনো সমস্যাই স্থায়ী নয়, আল্লাহর উপর আস্থা রাখলে আমাদের সকল সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আল্লাহর জিকির কেবল আমাদের মানসিক প্রশান্তি দেয় না, বরং আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত ও সাহায্যের দুয়ারও খুলে দেয়।

পরিশেষ

আলী (রাঃ) এবং ফাতিমা (রাঃ) এর জীবন থেকে আমরা উপলব্ধি করি, জীবনের প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি কোনো পার্থিব সম্পদে নয়, বরং তা আল্লাহর প্রতি একাগ্র বিশ্বাস, নির্ভরতা এবং তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপনে নিহিত। অভাব দূরীকরণের জন্য আল্লাহর জিকির ও তাঁকে স্মরণ করাই হলো সেরা আমল।

 

হাশরের দিন আল্লাহ যে তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ  

প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের জীবন পরিচালনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই শিক্ষার আলোকে কিয়ামতের দিন তিন ধরনের মানুষ এমন আছে, যাদের সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এই বিষয়ে আলোচনা এসেছে, যা আমাদের সতর্ক করে এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজেই সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দেয়।

হাদিসের বর্ণনা

আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘‘তিন ধরনের লোক এমন আছে, যাদের সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা কথা বলবেন না, তাদের দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।’’ তখন আবু হুরাইরা (রা.) বললেন, ‘‘হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা?’’ (মুসলিম, হাদিস: ২৯৪)

এই তিন শ্রেণির লোক কারা এবং তারা কোন কাজগুলো করেন যার ফলে তারা আল্লাহর এই অসন্তুষ্টি অর্জন করেন, চলুন তা আলোচনা করি।

তিন ধরনের ব্যক্তির অপরাধ

১. অহংকারী ব্যক্তি, যারা গর্বের সাথে পোশাক টেনে হাঁটে
এ শ্রেণির মানুষ নিজেদের গৌরব ও অহংকার প্রদর্শনের জন্য তাদের পোশাক মাটিতে টেনে টেনে হাঁটে। এ ধরনের আচরণে তারা নিজের মধ্যে একটা “বড়ত্ব” ও অহংকার প্রদর্শন করেন, যা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয়। ইসলাম বিনয় ও নম্রতাকে খুবই গুরুত্ব দেয় এবং অহংকারকে একটি মারাত্মক পাপ হিসেবে গণ্য করে। অহংকার মানুষকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে না, বরং দূরে ঠেলে দেয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারকারীদের পছন্দ করেন না।’’ (সূরা লুকমান, আয়াত ১৮)

২. ব্যবসায়ী, যারা মিথ্যা শপথ করে বিক্রি করে
এই শ্রেণির মানুষ ব্যবসার ক্ষেত্রে মিথ্যা কসম খেয়ে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করে তাদের ব্যবসা চালায়, যা ইসলামে খুবই ঘৃণিত কাজ। এ ধরনের মিথ্যা প্রতারণা শুধুমাত্র ব্যবসায়ে নয়, বরং সমাজেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করে। আল্লাহ বলেন, ‘‘আল্লাহ মিথ্যাবাদী এবং প্রবঞ্চকদের পছন্দ করেন না।’’ (সূরা নিসা, আয়াত ৩৬)

৩. মিথ্যা প্রতিশ্রুতির অপব্যবহারকারী
এ শ্রেণির মানুষ কথার খেলাপ করে। তারা এমন প্রতিশ্রুতি দেয় যা পূরণ করে না, ফলে অন্যদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। ইসলাম সততা ও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তাই এই ধরনের আচরণ ইসলামে অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহ বলেন, ‘‘প্রতিশ্রুতি পূরণ করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’’ (সূরা আল-ইসরা, আয়াত ৩৪) এ ধরনের মিথ্যাচার একদিকে অন্যের বিশ্বাস ভঙ্গ করে, অন্যদিকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে ঠেলে দেয়।

কেন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না?

কিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন আমাদের সামনে উপস্থিত হবেন, তখন তার সাথে কথা বলা বা তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকানোর মতো সৌভাগ্য একটি বিরল এবং মহামূল্যবান বিষয় হবে। কিন্তু এই তিন ধরনের মানুষ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, কারণ তাদের অপরাধ আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয় এবং তারা এই দুর্দশার মধ্যে পড়বেন তাদের অপরাধের জন্য। আল্লাহর সাথে কথা বলার এবং তার রহমতের দৃষ্টি অর্জন করতে না পারার ফলে তাদের ওপর একটি চরম শাস্তি নির্ধারিত হবে, যা তাদের জীবনের চূড়ান্ত দুর্ভাগ্য বলে বিবেচিত হবে।

আমাদের করণীয়

এই হাদিসটি আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যেন আমরা এই ধরনের আচরণ থেকে নিজেদের দূরে রাখি। অহংকার, প্রতারণা, এবং মিথ্যাচার ইসলামে গর্হিত কাজ, যা একজন মুমিনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। আমাদের প্রতিটি কাজের মধ্যেই বিনয়, সততা, এবং সতর্কতার প্রয়োজন।

পরিশেষে

কিয়ামতের দিন আল্লাহর রহমত এবং তার সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে আমাদের জীবনকে আল্লাহর নির্দেশনা ও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই গর্হিত কাজ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের জীবনে সততা, বিনয় এবং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে কিয়ামতের দিন তার সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন।

 

যৌবনের ইবাদত: আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং মূল্যবান একটি অধ্যায়

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ  

যৌবনকাল হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী, চাঞ্চল্যপূর্ণ এবং প্রেরণাদায়ক সময়। এ সময় মানুষ যে উদ্যম, আশা আর ক্ষমতা নিয়ে জীবনযাপন করে, তা আর কোনো সময় থাকে না। ইসলামে এই যৌবনকালকে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত হিসেবে দেখা হয়, এবং এই সময়ের সঠিক ব্যবহার আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক বড় উপায়। যৌবন শুধুমাত্র বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আনন্দ কিংবা খেলার জন্য নয়; বরং আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করে জীবন গড়ে তুলতে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।

আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “যেদিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ধরনের মানুষকে আল্লাহ তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হল সেই যুবক, যার যৌবন কাটে আল্লাহর ইবাদতে।” (বুখারি, হাদিস ৬৬০)।

কেন আল্লাহর কাছে যৌবনের ইবাদত এত প্রিয়?

আল্লাহ আমাদের জীবনকে পরীক্ষা করার জন্য যৌবনের এই বিশেষ সময় দিয়েছেন, যাতে আমরা এই শক্তি, ক্ষমতা ও উদ্দীপনার মধ্যে তাঁর নির্দেশ পালন করতে পারি। এই সময়টিতে বিভিন্ন প্রলোভন এবং বাধা আসতে পারে, যা আমাদের আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে। তবুও যারা আল্লাহর জন্য এই সময়টাকে ইবাদতে ব্যয় করেন, তারা প্রকৃত সফল।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে এবং পাপ থেকে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন।” এই কথা স্মরণ রেখে যারা প্রলোভন থেকে নিজেদের দূরে রেখে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করেন, তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ মর্যাদা।

যৌবনের ইবাদতের সাথে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ

যৌবনের ইবাদত শুধু শারীরিক নয়, এটি এক ধরনের আত্মিক চর্চা। ইসলামে ইবাদত কেবল নামাজ, রোজা কিংবা কুরআন পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইবাদত হলো আমাদের জীবনের প্রতিটি কর্ম, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়। সৎ কাজ করা, অন্যদের সহায়তা করা, সত্যবাদিতা ও পরোপকার করা—এসবই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। একজন যুবক বা যুবতী যখন তাদের জীবনের প্রতিটি দিককে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত করে, তখন সেটি আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে প্রিয় হয়।

বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিকোণে ইবাদতের গুরুত্ব

বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে যে ইবাদত এবং আল্লাহর স্মরণ মানুষের মন ও শরীরকে সুস্থ রাখে। ইবাদত মানসিক চাপ কমায়, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, এবং মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ইবাদত করেন তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে। আল্লাহর স্মরণ আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়, যা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে।

সমাজে ইবাদতের প্রভাব

যৌবনে ইবাদত করা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়; বরং এটি সমাজে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইবাদতে মগ্ন যুবকেরা তাদের চরিত্র ও আচার-আচরণ দ্বারা সমাজে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। তারা পরিবার ও সমাজে ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। যারা আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে সমর্পণ করেন, তারা পাপ থেকে দূরে থাকেন এবং অন্যদেরকেও সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন। এভাবে তারা সমাজকে উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কিভাবে যৌবনে ইবাদতের অভ্যাস গড়ে তোলা যায়

১. নিয়মিত নামাজ আদায়: নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। এটি মনকে প্রশান্ত রাখে এবং আল্লাহর রহমত লাভের পথ তৈরি করে।

২. কুরআন তেলাওয়াত: প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করে এবং আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার দিকনির্দেশনা দেয়।

৩. ইসলামী শিক্ষাগ্রহণ: ইসলামিক জ্ঞান এবং হাদিসের শিক্ষাগুলো অনুসরণ করে আল্লাহর পথে চলার শক্তি অর্জন করা সম্ভব।

৪. সৎ সঙ্গ বজায় রাখা: ভালো সঙ্গী মানুষের ইমান বাড়ায় এবং আল্লাহর পথে থাকতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৫. নফল রোজা রাখা: রোজা রাখা আত্মাকে পাপ থেকে রক্ষা করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক।

পরিশেষে

যৌবন হলো আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং মূল্যবান একটি সময়, যা আমাদের জীবনের এক পরীক্ষা হিসেবে এসেছে। যারা এই সময়কে ইবাদতের মাধ্যমে কাটায়, তারা পৃথিবীতেও প্রশান্তি লাভ করে এবং আখিরাতে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হবে। যৌবনের এই সময়কালে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়া এক ধরনের আত্মিক পরিতৃপ্তি এনে দেয় এবং আখিরাতের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনে। যৌবনের ইবাদত আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যায় এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।

আমাদের যৌবনকে ইবাদতে ব্যয় করা আসলেই এক বিশেষ নেয়ামত। যারা আল্লাহর পথে নিজেদের উৎসর্গ করেন, তারা আল্লাহর কাছেই অনুগ্রহপ্রাপ্ত হন।

 

ইসলামই লিবারেলিজম বা উদারবাদ থেকে মুক্তির প্রকৃত পথ

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ

লিবারেলিজম বা উদারবাদ একটি মতবাদ, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবাধিকার, এবং গণতান্ত্রিক নীতির ওপর ভিত্তি করে। এই মতবাদের প্রভাব সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনেক সমাজ এই নীতিকে গ্রহণ করেছে। তবে লিবারেলিজম অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সমাজের আসল চাহিদাগুলিকে উপেক্ষা করে। এর কারণে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক অবিচার এবং আত্মকেন্দ্রিকতার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় ইসলাম একটি আদর্শ বিকল্প হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যা মানবজীবনের সর্বোত্তম মূল্যবোধ এবং শান্তির ভিত্তিতে গঠিত।

লিবারেলিজমের প্রভাব

লিবারেলিজম মানুষের স্বাধীনতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা, মানসিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সমাজে নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দেয়। বর্তমানে এটি মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কিন্তু এর সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে, যা সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। লিবারেলিজমের কারণে সমাজে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়েছে, সামাজিক দায়িত্ববোধ কমে গেছে, এবং নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এর ফলে সমাজে বিচ্ছিন্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং অব্যবস্থাপনার প্রবণতা বেড়েছে।

 ইসলাম কি?

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যা কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি জীবনের সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সম্মান, দায়িত্ববোধ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। ইসলাম মানুষের জীবনে সব সময় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে এবং নৈতিকতার মান বজায় রাখতে সাহায্য করে।

 লিবারেলিজম বনাম ইসলাম: পার্থক্য

লিবারেলিজমের মূল ভিত্তি হলো ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং নিজস্ব পছন্দমতো জীবনের পথ বেছে নেওয়া। অন্যদিকে ইসলাম এই স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিক দায়িত্ব এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যকে গুরুত্ব দেয়। যেখানে লিবারেলিজম আত্মকেন্দ্রিকতাকে উৎসাহিত করে, সেখানে ইসলাম ব্যক্তির চেয়ে সমাজ এবং পারিবারিক বন্ধনকে অগ্রাধিকার দেয়।

লিবারেলিজমের আরও একটি বড় সমস্যা হলো এর নৈতিকতার সীমাহীনতা। উদারপন্থার নাম করে অনেকে নিজের ইচ্ছামত কাজ করে এবং এর ফলস্বরূপ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ইসলাম এই ক্ষেত্রে একটা সুনির্দিষ্ট নৈতিক সীমা নির্ধারণ করে, যেখানে সবার অধিকার এবং কর্তব্য স্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকে। ইসলাম জানায়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দায়িত্বশীলতা এবং পরোপকারিতা থাকা উচিত, যা সমাজকে সুসংহত করে এবং উন্নতির দিকে নিয়ে যায়।

পারিবারিক মূল্যবোধ রক্ষায় ইসলাম

লিবারেলিজমে পারিবারিক বন্ধনকে প্রাধান্য দেয়া হয় না, যার ফলে পারিবারিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম পারিবারিক বন্ধনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। পিতা-মাতার অধিকার, সন্তানের অধিকার এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলাম বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করে। এটি পরিবারকে সুসংহত রাখে এবং নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। লিবারেলিজমের মতবাদ যেখানে বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতাকে উৎসাহিত করে, সেখানে ইসলাম পরিবারকে মানুষের জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে।

 সামাজিক দায়িত্ব ও ন্যায়বিচারের গুরুত্ব

ইসলামে সামাজিক দায়িত্ব পালনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ইসলাম ব্যক্তিগত লাভের চেয়ে সামাজিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যাকাতের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র ও অভাবীদের সহায়তা করা ইসলামের অন্যতম প্রধান নীতিগুলির একটি। এছাড়া, ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করে। এটি সমাজের দুর্বল মানুষদের সুরক্ষা প্রদান করে এবং ধনী-গরীবের ব্যবধান কমায়। অন্যদিকে, লিবারেলিজমে সামাজিক দায়িত্ব বা দানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই, যা ধনী-গরীবের মধ্যে বিভাজন বাড়ায়।

 আত্মবিশ্বাস এবং আত্মউন্নয়ন

ইসলামে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মউন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলাম ব্যক্তি উন্নতির প্রতি উৎসাহিত করে, কিন্তু তা যেন সমাজের ক্ষতি না করে। ইসলাম প্রত্যেককে শিক্ষা দেয় যে নিজের উন্নতি করার জন্য আল্লাহর পথে চলা এবং নৈতিকতার মানদণ্ড বজায় রাখা অপরিহার্য। লিবারেলিজম ব্যক্তির উন্নতিকে গুরুত্ব দেয়, তবে তা এমন একটি মনোভাব গড়ে তোলে যেখানে অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ কমে যায়।

 বিজ্ঞান এবং ইসলাম

ইসলামে বিজ্ঞান এবং জ্ঞানার্জনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কুরআনেও জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ বলেন, “তোমরা পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আলাক, ৯৬:১)। এছাড়া, হাদিসেও নবী মুহাম্মদ (সা.) যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো পথ ধরে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।”
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ২৬৯৯) । এর মাধ্যমে ইসলাম জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করেছে, যেখানে লিবারেলিজমও জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব দিলেও তা সীমিত আকারে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উন্নয়নের কথাই বলা হয়।

 ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষা

লিবারেলিজম ধর্মীয় বিষয়গুলোকে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। এর ফলে সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ কমে যায় এবং মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়ে যায়। ইসলাম এই ক্ষেত্রে সমাজের ধর্মীয় মূল্যবোধকে রক্ষা করে এবং নৈতিকতাকে জীবনের অংশ হিসেবে তুলে ধরে। ইসলামে পাপ ও পূণ্যের ধারণা মানুষকে সঠিক পথে চালিত করে, যা মানুষের আচরণকে সুস্থির রাখতে সাহায্য করে। ইসলাম মানুষকে তার কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনে এবং তা তাকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে।

 উদারতাবাদে স্বাধীনতার ভুল ব্যাখ্যা

লিবারেলিজম ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়, যা অনেক সময় অনৈতিক কার্যকলাপের দিকে পরিচালিত করে। ইসলামে স্বাধীনতার সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা সমাজের কল্যাণের সাথে সম্পর্কিত। ইসলাম বলে, “তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো।” ইসলামে সমাজের কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান এবং নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যা সমাজকে সুন্দর এবং শান্তিময় রাখতে সাহায্য করে।

পরিশেষে  

লিবারেলিজম ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও এর মাধ্যমে মানবজীবনে উন্নতির চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা প্রদান করে যা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক এবং ধর্মীয় উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়। এটি পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করে, নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষা করে এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটায়। ইসলামের আদর্শ একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস ও আত্মউন্নয়নের সুযোগ দেয়, তেমনি তা সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করতে মানুষকে উৎসাহিত করে।

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। বর্তমান সময়ে লিবারেলিজমের সীমাবদ্ধতা এবং এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো আমাদের চোখে স্পষ্ট। এই অবস্থায় ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে উদারবাদের চেয়ে কার্যকর এবং মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।

 

ঘুমের প্রয়োজনীয়তা এবং জীবনের সফলতার সাথে এর সম্পর্ক

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ

আমাদের প্রতিদিনের ব্যস্ততার শেষে শরীর ও মনকে বিশ্রাম দিতে ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে একটি গভীর এবং নির্দিষ্ট সময়ের ঘুম আমাদের শরীর ও মনকে নতুন উদ্যমে শুরু করার জন্য প্রস্তুত করে। ঘুম শরীরের ক্লান্তি দূর করে, মানসিক চাপ কমায় এবং আমাদের মস্তিষ্ককে পুনরায় চার্জ করে দেয়।

বিজ্ঞান বলছে, ঘুম কেবল শরীরের জন্যই নয়, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক জীবনযাপনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যারা প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমান তারা কেবল শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন না, বরং তাদের মনোযোগ, কর্মক্ষমতা, এবং মনের প্রশান্তিও বজায় থাকে। রাতের ঘুম ঠিকমতো না হলে অনেকেই সকালে উঠে ক্লান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত অনুভব করেন, কাজে মন বসাতে পারেন না, আর মেজাজ খিটখিটে থাকে। এই বিষয়গুলো সরাসরি তাদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলে।

তবে ব্যস্ত জীবন, দুশ্চিন্তা, এবং বিভিন্ন মানসিক চাপের কারণে ঘুমে সমস্যা হওয়াটা আজকাল খুবই স্বাভাবিক। অনেকেই রাতে ঘুম আসার জন্য ঘুমের ঔষধ গ্রহণ করেন, কিন্তু এর মাধ্যমে সত্যিকারের গভীর ঘুম পাওয়া সম্ভব নয়। এই ধরনের ঘুম আমাদের শরীর এবং মনকে পুনরুদ্ধার করতে অক্ষম থাকে। তাই ঘুমের ঔষধের বদলে প্রাকৃতিক উপায়ে ঘুমানোর চেষ্টা করাই ভালো।

বয়স অনুযায়ী ঘুমের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের বয়সের সাথে ঘুমের চাহিদা পরিবর্তিত হয়। যেমন:

  1. নবজাতক (০-১ বছর): এই বয়সে শিশুদের প্রতিদিন প্রায় ১২-১৬ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন হয়। এ ঘুম তাদের শরীর ও মনের বিকাশে অত্যন্ত সহায়ক।
  2. ৩-৫ বছর বয়স: এই বয়সের শিশুরা ১০-১৩ ঘণ্টা ঘুমায়। ঘুম তাদের শরীর এবং মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে।
  3. ৬-১২ বছর বয়স: স্কুলগামী শিশুদের প্রতিদিন ৯-১১ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। এটি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করে এবং স্কুলের পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে।
  4. ১২-১৮ বছর বয়স: এই বয়সে কিশোরদের জন্য প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। এসময় শরীর ও মনের দ্রুত বিকাশ ঘটে, তাই পর্যাপ্ত ঘুম তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
  5. ১৮ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়স: প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাধারণত ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। এ ঘুম তাদের শারীরিক ও মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক।

সফলতার সাথে ঘুমের সম্পর্ক

ঘুম আমাদের কর্মক্ষমতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের দক্ষতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। যদি আমরা পর্যাপ্ত ঘুম না পাই, তাহলে মনোযোগ কমে যায়, ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায় এবং মানসিক চাপ বাড়ে। অন্যদিকে, যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমান তারা আরও কর্মক্ষম, মনোযোগী এবং মানসিক চাপ কম অনুভব করেন।

আমাদের জীবনের সফলতার জন্য যে ফোকাস ও শক্তি প্রয়োজন, তার মূল ভিত্তি হলো একটি সুস্থ শরীর ও মন। আর এই শরীর ও মনের পুনর্জাগরণের অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে ঘুম। তাই জীবনে সফলতা অর্জনে সঠিকভাবে ঘুমানোর গুরুত্বকে অবহেলা করা যাবে না।