মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগ
হযরত আলী (রাঃ) এবং ফাতিমা (রাঃ) এর দাম্পত্য জীবন ছিল এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে তারা দুনিয়ার সম্পদ কিংবা বিলাসিতার পিছনে ছুটে না গিয়ে আত্মবিশ্বাস ও সবর দিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের জীবনে অনেক সময় অভাব-অনটন এসেছে, কিন্তু তারা কখনো ধৈর্য হারাননি। বরং তাদের জন্য প্রকৃত সমৃদ্ধি হলো আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং নিরলস পরিশ্রম ও ইবাদতের মাধ্যমে অভাব-অনটনকে মোকাবেলা করা।
একদিন ফাতিমা (রাঃ) তাঁর পিতা, নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে আর্থিক সাহায্য চান। ফাতিমা (রাঃ)-এর শরীর কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। নবী (সাঃ) তার কন্যার কথা শুনে পরামর্শ দেন একটি বিশেষ আমল করার জন্য, যা অভাব থেকে মুক্তি দিতে পারে এবং তাদের সংসারকে বরকতময় করতে পারে।
নবী (সাঃ) কর্তৃক নির্ধারিত আমল
নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ফাতিমা (রাঃ) এবং আলী (রাঃ)-কে উপদেশ দেন যে, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তারা কিছু বিশেষ জিকির করবেন। আমলটি ছিল খুবই সহজ:
- ৩৩ বার সোবহানাল্লাহ – “পবিত্র আল্লাহ” বলে স্মরণ করা। আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসা করা।
- ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ – “আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা” বলতে বলা হয়, যা আল্লাহর প্রতিটি নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।
- ৩৪ বার আল্লাহু আকবার – “আল্লাহ সর্বশক্তিমান” বলা, যা আল্লাহর মহত্ত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ আমলটি ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও ভরসার প্রতীক, এবং তা শুধু আলী ও ফাতিমা (রাঃ) এর জীবনেই নয়, বরং প্রতিটি মুসলিম পরিবারে অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা দুঃখ-কষ্ট ও কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য কার্যকরী হতে পারে।
অভাব দূরীকরণের ব্যাখ্যা
ইসলামের দৃষ্টিতে, অভাবের মূল কারণ শুধুমাত্র সম্পদের অভাব নয়; বরং তা আমাদের অন্তরের অবস্থা এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ঘাটতিও হতে পারে। যখন আমরা আমাদের জীবনে আল্লাহর স্মরণে আত্মনিবেদন করি এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি, তখন আল্লাহ আমাদের জীবনে বরকত দেন। তাই আল্লাহর প্রশংসা করা এবং তাঁকে স্মরণ করা হলো একধরনের ইবাদত, যা দুনিয়ার অভাব থেকে আমাদের রক্ষা করে। আল্লাহর উপর নির্ভরতা আমাদের মনের প্রশান্তি এনে দেয় এবং এই প্রশান্তির কারণেই আল্লাহ আমাদের অভাব দূর করেন।
আলী (রাঃ) ও ফাতিমা (রাঃ)-এর জীবনের শিক্ষা
আলী (রাঃ) এবং ফাতিমা (রাঃ) এর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে, ধৈর্য এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতা আমাদের জীবনে আনে প্রকৃত সুখ। তারা দুনিয়ার সম্পদের পিছনে না ছুটে আল্লাহর স্মরণে এবং তার ইবাদতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এমনকি দুঃসময়ে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা অটুট রেখেছেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে আমাদের জীবনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়:
- কৃতজ্ঞতা: কৃতজ্ঞ হওয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর করুণা লাভ করি, যা আমাদের জীবনের অভাবকে পূর্ণতা দেয়।
- ধৈর্য: ধৈর্যের মাধ্যমে আমরা জীবনের সংকটগুলোকে মোকাবেলা করতে পারি এবং সফলতার পথে এগিয়ে যেতে পারি।
- আল্লাহর স্মরণ: আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর সাথে সম্পর্ক তৈরি করার মাধ্যমে আমাদের জীবন হয়ে ওঠে শান্তিময় এবং বরকতময়।
এই আমলের আধুনিক প্রেক্ষাপট
বর্তমান যুগে, মানুষের মনে বিভিন্ন রকমের দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ এবং অভাব-অনটন বিরাজ করে। অনেকেই হয়তো আর্থিক সংকট বা জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েন। নবীজির (সাঃ) এই উপদেশ আমাদের শেখায়, কোনো সমস্যাই স্থায়ী নয়, আল্লাহর উপর আস্থা রাখলে আমাদের সকল সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আল্লাহর জিকির কেবল আমাদের মানসিক প্রশান্তি দেয় না, বরং আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত ও সাহায্যের দুয়ারও খুলে দেয়।
পরিশেষ
আলী (রাঃ) এবং ফাতিমা (রাঃ) এর জীবন থেকে আমরা উপলব্ধি করি, জীবনের প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি কোনো পার্থিব সম্পদে নয়, বরং তা আল্লাহর প্রতি একাগ্র বিশ্বাস, নির্ভরতা এবং তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপনে নিহিত। অভাব দূরীকরণের জন্য আল্লাহর জিকির ও তাঁকে স্মরণ করাই হলো সেরা আমল।