সুখী ও সফল আগামীর জন্য প্যারেন্টিং গাইড (পর্ব – ৩)

শিশুমনস্তত্ত্বের বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠন (৭ বছর – ১২ বছর)

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগঃ শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ এবং পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য পিতামাতার ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে যখন শিশুরা ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে থাকে, তখন তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। এ বয়সে শিশুদের মনের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তাদের চিন্তাশক্তি ও আত্মপরিচয় বিকাশ লাভ করে। কুরআন ও হাদিসে পিতামাতার জন্য যে নির্দেশনা রয়েছে, তা অনুসরণ করে একটি সঠিক প্যারেন্টিং কৌশল গঠন করা সম্ভব।

শিশুমনস্তত্ত্বের বিকাশের গুরুত্ব

শিশুদের মানসিক বিকাশ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের চারপাশের মানুষ ও পরিবেশ তাদের চিন্তাধারা, আচরণ, এবং ব্যক্তিত্ব গঠনে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন:

পড়, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন” (সুরা আলাক, ৯৬:১)

এই আয়াতটি থেকে বোঝা যায় যে, শিক্ষার গুরুত্ব কতটা গভীরভাবে ইসলামে স্থান পেয়েছে। শিক্ষা হলো শিশুর বিকাশের প্রথম ধাপ। তবে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তিও পিতামাতাকে তৈরি করতে হবে।

শিশুদের এই বয়সের বিকাশের ওপর নির্ভর করে তাদের ভবিষ্যতের ব্যক্তিত্ব। এ কারণে পিতামাতার দায়িত্ব হলো শিশুর এই বিকাশের প্রতিটি ধাপে সঠিক নির্দেশনা ও মূল্যবোধ প্রদান করা।

৭-৯ বছর বয়সী শিশুদের বৈশিষ্ট্য

৭ থেকে ৯ বছরের মধ্যে শিশুরা ধীরে ধীরে তাদের বাস্তবিক চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। এ সময় শিশুরা তাদের চারপাশের জগতকে নতুন করে বুঝতে শুরু করে এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করে। তারা তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া উন্নত করতে থাকে এবং নতুন অভিজ্ঞতা থেকে শেখার ক্ষমতা বাড়ে।

হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

প্রত্যেক তোমাদের একজন রাখাল, এবং তোমরা সবাই তার অধীনে থাকা লোকজনের জন্য দায়ী” (সহীহ বুখারি, ৮৯৩)

এই হাদিসের দ্বারা বোঝা যায়, পিতামাতার দায়িত্ব হলো তাদের সন্তানদের জন্য পথপ্রদর্শক হওয়া। ৭ থেকে ৯ বছরের শিশুদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়, কারণ এই বয়সে তারা শেখার জন্য প্রস্তুত থাকে এবং তাদের আচরণের ভিত্তি গড়ে ওঠে। তাদের সামনে ভালো উদাহরণ স্থাপন করতে হবে, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।

এই বয়সে শিশুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়তে শুরু করে। তারা ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব নিতে শেখে এবং এতে তাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। পিতামাতার উচিত শিশুদের বিভিন্ন কাজের জন্য দায়িত্ব দিতে শুরু করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।

১০-১২ বছর বয়সী শিশুদের মানসিক বিকাশ

১০ থেকে ১২ বছরের শিশুদের মানসিক বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে তারা স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের দিকে ঝোঁকে। তারা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে ভালোবাসে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে চায়। সমবয়সীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার দক্ষতা এ বয়সে বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী করতে চায়।

এ সময় পিতামাতার দায়িত্ব শিশুদের সঠিক পথ দেখানো, তাদের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়ে এক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করা। নবী করিম (সা.) বলেন:

তোমাদের সন্তানদের প্রথম সাত বছর ভালোবাসো, পরের সাত বছর শাসন করো, আর পরবর্তী সাত বছর তাদের বন্ধু হও” (মুস্তাদরাক আল-হাকিম)

এই হাদিসের নির্দেশনায় বোঝা যায়, শিশুদের জীবনের প্রথম ১৪ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রতিটি ধাপে পিতামাতাকে তাদের ভিন্নভাবে পরিচালনা করতে হবে। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে শিশুদের শাসন ও নির্দেশনার প্রয়োজন, যাতে তারা সঠিক পথে থাকতে পারে।

শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে পিতামাতার ভূমিকা

শিশুরা তাদের আশেপাশের পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে। পিতামাতার আচরণ, তাদের কথাবার্তা এবং জীবনযাপন শিশুদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। শিশুরা খুবই অনুভূতিপ্রবণ হয়, এবং পিতামাতার নির্দেশনায় তারা সঠিক বা ভুল পথ বেছে নেয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন:

তোমাদের নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো যার জ্বালানি মানুষ এবং পাথর” (সুরা তাহরিম, ৬৬:৬)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, পিতামাতার দায়িত্ব তাদের সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করা, যাতে তারা দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্য সফল হতে পারে।

শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানদের মধ্যে নৈতিকতা, ইমান, এবং শিষ্টাচার শেখানো। শিশুরা যা দেখে এবং শোনে, তা তাদের আচরণ ও চিন্তায় প্রতিফলিত হয়। তাই পিতামাতার দায়িত্ব হলো তাদের সামনে এমন উদাহরণ স্থাপন করা, যা তাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্যারেন্টিং কৌশল

১. শিশুর প্রতি ভালোবাসা ও শাসনের মিশ্রণ

পিতামাতার উচিত তাদের শিশুদেরকে প্রথম সাত বছর ভালবাসা এবং মমতায় রাখার পরে পরবর্তী সাত বছর তাদের শাসনের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত করা। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দেশনা দিয়েছেন:

তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের আদেশ দাও এবং দশ বছর বয়সে শাসন করো, যদি তারা তা পালন না করে” (আবু দাউদ)

এই নির্দেশনা অনুযায়ী, শিশুদের শৈশব থেকেই ইসলামী ইবাদত ও আচরণের প্রতি গুরুত্ব দিতে শেখানো উচিত। পিতামাতার দায়িত্ব হলো শিশুদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।

২. শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ

ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআনে বারবার শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

পড়, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন” (সুরা আলাক, ৯৬:১)

শিক্ষা হলো শিশুর বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক বিকাশের মূল ভিত্তি। পিতামাতার দায়িত্ব তাদের সন্তানদের শৈশব থেকে শিক্ষা অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করা। তবে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ওপরও জোর দেওয়া প্রয়োজন।

৩. নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো

শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ শেখানোর দায়িত্ব পিতামাতার। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

মানুষ তার বন্ধুর ওপর প্রভাবিত হয়, তাই তোমরা দেখে নাও তোমাদের কারা বন্ধু হচ্ছে” (তিরমিজি)

শিশুদেরকে সঠিক বন্ধু বেছে নিতে সাহায্য করা এবং তাদের চারপাশের পরিবেশের ওপর নজর রাখা প্রয়োজন। শিশুরা খুব সহজেই তাদের সমবয়সীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়, এবং সঠিক বা ভুল দিক বেছে নেয়।

শিশুমনস্তত্ত্বের বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠন প্যারেন্টিং-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করা, তাদের মধ্যে নৈতিকতা, ইমান, এবং শিষ্টাচারের বিকাশ ঘটানো। শিশুদের এই বয়সে যত্নবান হওয়া তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করবে। সঠিক প্যারেন্টিং কৌশল অবলম্বন করে শিশুদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব, যা তাদের আখিরাতের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করবে।

 

 

Recommended